Saturday 21 March 2015

কাল নদী



দূর থেকে দেখলে প্রান্তরেখায় একটা ন্যাড়া গাছ চোখে পড়ে। তারপর সমতল জমির পরিবর্তে একটা শূন্য জায়গামতন। ওখানেই ওটা। ছোট্ট একটা নদী। শেষটা কোথায় জানা যায় না। তবে ছোট নদী হিসেবে জন্মটা সাদামাটাই বলা চলে। করতোয়ার পাজর ঠেলে বেরিয়ে আসা একটা অর্বুদ। প্রতিদিন বড় হতে হতে নদী নাম নিয়ে ফেলেছে। নামটা আবার দশাসই, কাল নদী। কবে কার কাল হয়েছিল এলাকাবাসী জানে না। বংশ পরম্পরায় পিতামহ থেকে পিতামহে কিংবা মাতামহ থেকে মাতামহীর মাধ্যমে প্রচলিত হয়ে গেছে নামটা। তবে অনেকে বলে একসময় নদীর জল নাকি অনেকে কালো ছিল। কিন্তু কালো আর কাল এক হয় কি করে? দুটো তো আলাদা জিনিস। এই নদী কি বানের সময় বুকের সন্তান, পিঠের সন্তানসহ মাকে ডুবিয়ে কারও কাল হয়েছিল, নাকি ধানি জমির সোনারাঙ্গা ফসল ডুবিয়ে কাল হয়েছিল, সেটা বেচে না থাকা কেউ বলতে পারতেন। সেটা হয়ত কোন উপাখ্যান যা তাদের সাথেই মরে গেছে। নদীর নাম কেন কাল নদী তা উদঘাটন যোগ্য না হওয়ায়, কারণ ছাড়াই নদীর নাম কাল নদী

নদী থাকলে তার বয়ে চলাটাও থাকে। কাল নদীর বয়ে চলাটা আর দশটা ছোট নদীর মতই, ইনিয়ে বিনেয়ে। এখানে ডানে তো ওখানে বায়ে, হেলে দুলে কিছুটা আয়েশি চালে। নদীর ওপারে পশ্চিম পাড়া, এপাড়ে পুব পাড়া। মাঝখানে এই ছোট নদী যেন অনেক বিভেদ। এপাড়ার লোকজন কদাচিৎ এপাড়ে আর একইভাবে ওপাড়ার লোকজনকে খুব সামান্যই এপাড়ে আসতে দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হল দুই পাড়ের মানুষ একই আঞ্চলিকতার। দুই পাড়ের মানুষকেই নদী সমান যুত্নে, সমান শাসনে রাখে, তবুও যেন মানুষের মাঝে একটা সৎ সৎ ভাব। হয়ত একারণেও নদীর নাম কাল নদী, হয়ত দুই পাড়ের মানুষের সদ্ভাবের মাঝে কাল হয়ে দাড়িয়েছে বলে।

কোন এক চৈত্রের কথা। শীতের শষের নদীতে জল অনেক কম। পাড় ঘেসে একটা বক মনে পড়ে। গায়ের রঙ কি বা তার ছায়া নদীজলে পড়েছিল কি না, স্মৃতিতে ধুলোপড়ায় তা মনে আসে না। শুধু মনে পড়ে নদীজলে কী যেন খুজছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কী আর মাছ হবে হয়ত? বককে পেছনে ফেলে একটু সামনে এগিয়ে গেলে মানুষের হৈ হুল্লোড় শুনতে পাওয়া যায়। আর কিছু নয়, হাটুজলে আল দিয়ে নদী সেচে মাছ ধরা চলছে। এই হাটুজলে এই নদী যে এত মৎস সন্তান ধারণ করেছিল তা না দেখলে বোঝা যায় না। জলের সাথে মাছ ত ধরা পড়েই, জল সেচে পাকের ভেতরও মাছের কমতি হয় না। কোদাল দিয়ে আলতো করে কোপ দিলেই বেরিয়ে আসে কাদায় লুকিয়ে থাকা মাছ। অনেক অনেক কাদাচোরা মাছ। যখন একেক বার অনেক মাছ বেরিয়ে আসে পাকের তলা থেকে, তখন মাছ ধরা দেখতে আসা ছেলে-বুড়ো আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। সারাদিন মাছ ধরা চলতেই থাকে। দিনের শেষে কাল নদীর পাড়েই মাছের ভাগ ভিত্তে হয়ে যায়। রাতে গৃহস্থ বাড়িতে কাল নদীর মাছের তরকারি সেদিনের গল্পের খোরাক জোগায়। গল্প হয়, কাল নদীতে অনেক অনেক আগে আরও অনেক মাছ পাওয়া যেত। গল্প শেষে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।

বৈশাখেও কাল নদীর জল এবেবারে শুকিয়ে যায় না। জল শুকোলে নদীর মান সম্মান থাকে নাকি? জল শুকোয় না বটে তবে মুমূর্ষ প্রাণের মত পাড়ের কাছ ঘেষে সরু হয়ে যায় স্রোতধারা। এই অল্প জলেই রাখাল তার মহিষ জোড়া নিয়ে আসে গা ধুইয়ে দিতে। পরম মমতায় কাল নদীর জল অবলা দুটির কর্মক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। তারপর রাখাল কোমরে গামছা জড়িয়ে নিজেও কষ্ট করে দুটো ডুব দিয়ে নেয়। তবে বৈশাখের অল্পজল সবচেয়ে আনন্দ দেয় ছোট বাচ্চাদের। বাচ্চাদের তো আর মা-বাপ সহজে ছাড়ে না। তাই বলে গ্রামের ছেলেপুলে নদীতে গোসল দেবে না এটা কেমন কথা? যেহেতু বৈশাখ, হাটুজল, ছোটগুলো তাই পরমানন্দে জল ঘোলা করে নেয়। ন্যাংটো হয়ে আসে, ন্যাংটো হয়েই জল শুকোতে শুকোতে বাড়ি গিয়ে গর্বের সাথে কাল নদীর গোসলাভিযান ব্যাখ্যা করে মায়ের কাছে, কিংবা দাদীর কাছে, ফুপুর কাছে। নিজেও তাই করেছি। এই অল্প জলেও কার্পণ্য করে না কাল নদী। পাশের ছোট বীজতলা গুলোর সেচের কাজও চলে এই অল্প জলেই।

এলাকায় দটো বিল আছে। সাধরণত বিল আর নদী পাশাপাশি না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই এলাকায় আছে। শংকরা আর কুমারডুবি। কাল নদীর মতই অদ্ভুত সুন্দর নাম। এদের পেছনেও হয়ত অনেক সুতোয় বাধা কথা উপকথা আছে। কি জানি? বিল দুটো যেন সহোদর। অবস্থান পাশাপাশি। গরমকালে মর মর থাকে আর বর্ষায় ভালোই উথলে ওঠে। গ্রামের মানুষ দুই বিল থেকে ধর কেটে কাল নদীতে মিশিয়ে দেয়। কাল নদীকে তার দু’কূল ছাপিয়ে বাণ ডাকতে দেখা যায় না খুব একটা। তারপরও কেন যে বেচারা ‘কাল নিদী’? যা হোক, বিল আর নদী বর্ষায় এক করে দেয়া হয়। ‘জান’ দিয়ে মাছ ধরা চলে সারা বর্ষা। সে এক অন্য রকম উৎসব। অল্প জলে নয়, বেশি জলেই আর একবার গ্রামের মানুষ মাছ ধরে। বেড়ে উঠেলে আঙ্গুল সমান পুটিও যে বেশ বড় হয়, খলসে গুলোও যে কতটা বড় হতে পারে কাল নদীর মাছ তার প্রমাণ দেয়। কাল নদীতে কখনো মাছের অভয়ারণ্য করতে হয় নি। যেমনটা এখন করা হয় প্রচার করে। কাল নদী সারা বছর মাছের আধার হয়েই থাকে। রেল ব্রীজ থেকে থেকে চুটিকি জাল (ছোট জাল), টানা জাল, কিংবা সার করে পেতে রাখা বর্শায় মাছ আটকায় প্রচুর। ছোট জালে হঠাৎ চিতল জাতীয় মাছ ধরা পড়লে, সেটা ‘চিতল’ নাকি ‘ফলি’ এ নিয়েও চলে তর্ক। আবার পুকুর উছলে কোন মাছ বেরিয়ে এসেছে ভেবেও চলে আফসোস মাঝে মাঝে। রাতে হ্যাজাকের আলোয়, খচা দিয়ে, চাই দিয়ে মাছ ধরা চলে অবিরত। এক সময় বর্ষা শেষ হয়। থিতিয়ে পড়ে কাল নদী। বিলের ধরগুলো শুকিয়ে যায়। বিল ফিরে যায় বিলের জায়গায়। কাল নদী তার জায়গাতেই থাকে। অপেক্ষাটা আরেক বর্ষার।

কাল নদীর পাড় ঘেসে এক সময় বেড়ে ওঠে ‘মোথা’ আর ‘কাঁশবন’। কাঁশফুল একটু কম, মোথাই বেশি। দল বেধে মোথা কেটে নিয়ে যায় গ্রামের মানুষ। বাড়িতে বিছানা, পাটি, মাদুর তৈরী হয় কাল নদীর মোথা দিয়ে। বাজারে ওঠে সেসব। কেনার সময় খরিদদার জিজ্ঞেস করে, “কোনঠাকার মোথা ব্যাহে এতোটটা”। বিক্রেতা সম্ভ্রমে বলে, “কাল নদীর”। কাল নদী শরতে শুধু মোথাই দেয় না। মোথার জংলায় হাঁসদের ডিম দেওয়ার জায়গাও করে দেয়। গ্রামের ছেলেরা মোথার জংলায় ডিম খোঁজে। পেয়েও যায় কিছু। দুপুর বেলা হাসের নীলচে ডিম ভেজে ভাত খায়। বাড়িতে হাঁস-মুরগী নেই তা নয়, তবে এটা যে কাল নদীর উপহার। শরতেও সেঁচ চলতে থাকে নদীর জল দিয়ে। রাতে এক ঝাঁক তারা জোছনা সাথী করে নাইতে নামে কাল নদীর জলে। চাঁদ আনন্দে কাঁপা হাসি ছড়িয়ে দেয় দুই পাড়ে।
 
শীত এসে যায়। কাল নদী বুক পেতে দেয় ধানের বীজতলার জন্য। ভোরবেলা, সূর্য যখন ওঠো ওঠো, তখন কচি ধান গাছের ডগায় শুভ্র হিম জমে থাকে, ধোয়াটে আস্তর তৈরী করে। মাঝে মাঝে দেখা যায় বীজতলার কচি সবুজের মাঝ দিয়ে এঁকে-বেঁকে কিসে যেন হেঁটে গেছে। নদীর জল খুব কম। নদীর বুক এখন শামুক আর ঝিনুক ভর্তি। জুগিরা এসে চুনের জন্য কুড়িয়ে নিয়ে যায় এগুলো। স্থানীয় ভাষায় শামুক, ঝিনুককে একসাথে ‘টোকরাই’ বলে। সেই টোকরাই চুল্লিতে চুন হয়, কাল নদীর চুন। সন্ধ্যে বেলা গৃহস্থ বাড়ির চুলোর ধোঁয়া আর কুয়াশা মিশে কাল নদীর ওপর যেন একটা চাদর তৈরী করে। কেমন যেন শবযাত্রার নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারিদিক। কুয়াশার আস্তরণ সাথে করে নিয়ে আসে বিষণ্ণতা, যেখানে থাকতে পারে কাল নদীর বয়ে চলার একঘেয়েমির কষ্ট, কিংবা অন্য কিছু, তা কি আর বোঝার উপায় আছে। কাল নদী শুধু ধীরে ধীরে আঁধারে কালো হয়ে যায়।
 
(লেখাটি "তিস্তা" নামের একটি নদীপত্রে প্রকাশিত। "রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ" এর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে ২০১২ সালে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়; ছবিটি প্রতিকী)