মুহূর্তের গল্প
- কেট চোপিন
মিসেস
ম্যালার্ডের হৃদরোগের কথা জানায়, খুব সতর্কতার সাথে প্রায় আলগোছে তার কাছে তার
স্বামীর মৃত্যূর খবর দেওয়া হল।
তার বোন
জোসেফিন তাকে বললেন, ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাক্যে, আস্ফূট ইঙ্গিতে, যা প্রকাশ পেল আধো আধো
উন্মোচনে। তার স্বামীর বন্ধু রিচার্ডও ছিলেন সেখানে, তার কাছেই। তিনিই সেখানে
ছিলেন যখন “মৃত” তালিকায় মিঃ ম্যালার্ডের নাম সবার উপরে নিয়ে খবরের কাগজের অফিসে খবর পৌছায়। দ্বিতীয় টলিগ্রামে শুধু নিশ্চিত হয়ে যত দ্রুত ও যত্নের সাথে সম্ভব তিনি বন্ধু্র
মৃত্যুর খারাপ খবর পৌছালেন।
অনেক মহিলারা
যেমটা করেন, মানতে চান না ঘটনার বিহ্বলতার কারনে, তিনি তাদের মত করে খবরটা নিলেন
না। অকস্মাৎ তীব্র বেদনায় কেঁদে উঠলেন তার বোনের কোলে। যখন বেদনার ঝড় নিজে থেকেই মিইয়ে
গিল তিনি একাকি তার রুমে চলে গেলেন। চাইলেন না কেউ তাকে অনুসরণ করুক।
![]() | |
মুল গল্পঃ Story of an Hour |
ঘরে একটা
জানালামুখী, আরামী ঘরোয়া আর্ম চেয়ার। তিনি গা এলিয়ে দিলেন একটা নিংড়ানো
পরিশ্রান্তি নিয়ে যা তার শরীর ভেঙ্গে দিয়ে এবং আরও গভীরে তার সত্ত্বায় প্রবেশ করতে
চাইল।
বাড়ীর সামনের
চত্ত্বরে গাছের চূড়া গুলো তিনি দেখতে পারলেন। বসন্তের বাহারী জীবন। বাতাসে বৃষ্টির
তাজা নিঃশ্বাসের গন্ধ। নিচের রাস্তায় ফেরিওয়ালার ফেরি করার চিৎকার। কারও
গাইতে থাকা দূরবর্তী কোন গানের অন্তরা তার কানে লাগল আবছাভাবে, আর ঘরের কার্নিশে কিছু
চড়ুইয়ের কিচিরমিচির, পশ্চিম জানালামুখে দেখতে পেলেন থরে থরে সাজানো নীলাকাশের
টুকরো টুকরো মেঘ।
কাঁদতে কাঁদতে
ঘুমিয়ে পড়া শিশুর মত ফোঁপানী ছাড়া তিনি মাথা এলিয়ে পড়ে রইলেন প্রায় নিঃশ্বব্দে।
তিনি তরুনীই
ছিলেন, একটা নির্দোষ, শান্ত চেহারা, যার রেখাগুলো প্রমাণ দেয় অবদমনের এবং একটা
শক্তির। কিন্তু এখন সেখানে একটা ফাঁকা দৃষ্টি যা স্থির হয়ে আছে ঐ দুরের টুকরো
মেঘগুলোর কোন একটায়। এই চাহনি নিজেকে দেখার নয় বরং কিছু সন্দেহময় অন্তর্দষ্টির।
কিছু একটা আগমন
ঘটছিল তার ভেতর আর তিনি তার প্রতিক্ষা করছিলেন ভয়ে ভয়ে, এটা কি? তিনি জানতেন না;
নাম দেওয়ার জন্য এটা কিছুটা অতীন্দ্রীয় হেয়ালির মত। কিন্তু তিনি টের পেলেন, আকাশের
ভেতর থেকে লতিয়ে আসা, চিন্তাস্পর্শী শব্দগুলো, গন্ধগুলো, আর সেই বাতাস ভরানো
রংগুলো।
তার বুকের
খাঁচা দ্রুত আন্দোলিত হতে শুরু করল। তিনি বুঝতে শুরু করলেন তাকে অবিষ্ট করার জন্য
এগিয়ে আসা বিষয়টাকে, আর তিনি তার ইচ্ছা দিয়ে এটাকে ঠেলে পাঠাতে সংগ্রাম করছিলেন – তার তন্বী
হাতগুলো যেমনটা করত।
যখন তিনি হাল
ছাড়লেন তার আধখোলা ঠোটের ফাঁক গলে কিছু একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরুলো। তার নিঃশ্বাসের
উপর ভর দিয়ে বারবার বললেনঃ “মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি!” ঘোলা চাহনি আর পেছনে আসতে থাকা ভয়ের ছায়া
তার চোখ থেকে মুছে গেল। সেগুলো অত্যগ্রু আর আলোকিত হয়ে রইল। তার নাড়ি দ্রুত হল, আর
প্রবাহী রক্তধারা তার শরীরের প্রতিটি কোণ উষ্ণ ও শীথিল করে দিল।
তিনি জানতে
চাইলে না এটা কোন ভিতীকর আনন্দ কি না। একটা পরিষ্কার আর সমুচ্চ উপলব্ধি তাকে এই
উস্কানি অকিঞ্চিতকর মনে করার সাহস জোগাল। তিনি জানতেন তিনি আবার কাদঁবেন; যখন
তিনি মৃত্যুতে গুটিয়ে যাওয়া হাতগুলো দেখবেন; সেই স্থির নীরস মৃত চেহারাটা যা কখনই
তার দিকে সঞ্চিত ভালবাসা নিয়ে তাকায় নি। কিন্তু তিনি সেই তিক্ত মুহূর্তের ওপারে
অনাগত বছরের মিছিল দেখতে পেলেন যা একান্তই তার নিজের হতে চলেছিল। আর তিনি উদ্বাহু
হয়ে তাদের স্বাগত জানালেন।
আগামী বছরগুলোতে
তার সাথে কেউ থাকবে না; তিনি নিজের জন্য বাঁচবেন। কোন ইচ্ছাঘাতক থাকবে না যার
অন্ধ অস্তিত্ত্ব নর-নারীকে বিশ্বাস দেয় যে তারা তাদের ব্যক্তিইচ্ছা পাশের মানুষটির উপর
চাপিয়ে দিতে পারে। এই স্বল্প সময়ের ভালোলাগায়, কি জানি ভাল বা নিষ্ঠুর কারনে বিষয়টা
তার কাছে অপরাধের মত ঠেকল।
![]() |
মুক্তি |
তারপরও তিনি
তাকে ভালবাসতেন – কখনও কখনও। প্রায়ই বাসতেন না। কি এসে যায়! জীবনের তীব্র
অনুভুতিময় আত্মস্বীকৃতির কাছে অমমাংসিত ধাঁধার মত এই ভালবাসা কিইবা করতে পারে। “মুক্তি! দেহ আর
আত্মার মুক্তি!”, তিনি বিড়বিড়িয়ে চললেন।
জোসেফিন দরজায়
মুখ লাগিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছিলেন। “লুসি, দরজা
খোল! দোহাই; দরজা খোল – অসুস্থ হয়ে পড়বে। কি করছো, লুসি? ঈশ্বরের দোহাই দরজা
খোল।”
“যাও এখান থেকে। আমি অসুস্থ হব না।” না; তিনি খোলা
জানালা দিয়ে জীবিনের অমৃত পান করছিলেন। তার কল্পনা উদ্দাম ছুটছিল সামনের দিনগুলোর দিকে।
বসন্ত, গ্রীষ্ম, আর সব দিন গুলো যা তার শুধু নিজের হবে। তিনি দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা
করলেন। এইতো গতকালও তিনি শিহরিত হয়ে দীর্ঘ জীবনের প্রার্থানা করেছিলেন।
বোনের
পীড়াপীড়িতে অবশেষে দরজা খুললেন। তার চোখে বিজয়ের উত্তেজনা, তিনি নিজেকে বিজয়ী
ঈশ্বরীর মত করে সামনে আনলেন। বোনের কোমর জড়িয়ে ধরে সিড়ি বেয়ে নেমে এলেন। রিচার্ড
তাদের জন্য নিচে অপেক্ষায় ছিলেন।
কেউ একজন বাইরে
থেকে চাবি দিয়ে দরজা খুলছিল। দরজায় ব্রেন্টলি ম্যালার্ডকে দেখা গেল, ছাতা হাতে,
কিছুটা ভ্রমনক্লান্ত। তিনি দুর্ঘটনার স্থান থেকে অনেক দুরে ছিলেন, এমনকি কোন
দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানতেনই না। তিনি জোসেফিনের আর্ত চিৎকার আর রিচার্ডের দ্রুত পায়ে মিসেস ম্যালার্ডকে আড়াল করার চেষ্টার সামনে বিহ্বলের মত দাড়িয়ে থাকলেন। কিন্তু রিচার্ড বড্ড
দেরী করে ফেলেছিলেন।
ডাক্তাররা যখন
আসলেন, তারা বলেছিলেন তার (মিসেস ম্যালার্ড) মৃত্যু হয়েছিল হৃদরোগে – সেই আনন্দে যা
ঘাতক।